ঢাকা, ১অগ্রহায়ণ (১৬ নভেম্বর): গণভোটের ‘সময়’ ও ‘প্রশ্নের ধরন’ এবং জারিকৃত ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫’-এর বিভিন্ন বিষয়ে তক্কাতক্কি থাকলেও সংশ্লিষ্ট সব রাজনৈতিক দলেরই এখন পূর্ণ মনোযোগ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে।
বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), চরমোনাই পিরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, গণঅধিকার পরিষদ ও গণতন্ত্র মঞ্চসহ সব দল শুধু নির্বাচনমুখীই নয়, ভোটের মাঠে দৃশ্যমান সরব।
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণে ঘোষিত সিদ্ধান্তসমূহ এবং রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের জারিকৃত আদেশ অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গেই একত্রে পৃথক ব্যালটে গণভোট হবে।
আগামী জাতীয় সংসদ হবে দুই কক্ষ বিশিষ্ট—‘নিম্নকক্ষ’ ও ‘উচ্চকক্ষ’, নিম্নকক্ষের নির্বাচন বিদ্যমান ব্যবস্থাতেই হবে। তবে, ১০০ সদস্যের ‘উচ্চকক্ষ’ গঠন হবে ‘নিম্নকক্ষে’ দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে।
এসব সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে সন্তোষ-অসন্তোষ থাকলেও দলগুলোর কেউই তা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেনি। বিএনপি প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। জামায়াত ও চরমোনাই পিরের ইসলামী আন্দোলনসহ আটটি দল কিছুটা অসন্তোষ জানালেও আন্দোলনের বড় কর্মসূচিতে যাচ্ছে না। এনসিপি আদেশের বিষয়ে সরকারের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে, তবে আন্দোলনের কোনো কর্মসূচি দেয়নি। সরকার-সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র ইত্তেফাককে জানায়, অন্তর্বর্তী সরকার মনে করছে, সংশ্লিষ্ট প্রধান দলগুলোর দাবি-মতামতের সমন্বয় ঘটিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যেই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছে; সেটি দলগুলো কার্যত মেনে নিয়েছে। কারণ, এতে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি—তিনটি দলেরই কোনো না কোনো চাওয়া পূরণ হয়েছে।
দলগুলো দৃশ্যত ‘কিছুটা সন্তোষ, কিছুটা অসন্তোষ’- এমন ধাঁচের প্রতিক্রিয়া দেখালেও মূলত সব দলই এখন নির্বাচনমুখী। গত ৩ নভেম্বর বিএনপি ২৩৭টি আসনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে। পরবর্তীতে একটি আসনে মনোনয়ন স্থগিত করা হয়। দলের মনোনয়নপ্রাপ্তরা ইতিমধ্যেই নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকায় গণসংযোগে নেমে পড়েছেন। প্রতিদিনই গণসংযোগ, সভা-সমাবেশ ও উঠোন বৈঠক করছেন। ভোটারদের ঘরে-ঘরেও যেতে শুরু করেছেন। রাজধানীসহ সারা দেশেই বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে ভোট চেয়ে পোস্টার-ব্যানার সাঁটিয়েছেন। প্রার্থীদের বেশির ভাগই দলের ৩১ দফা কর্মসূচি সম্বলিত লিফলেট বিতরণ করছেন।
যেসব আসনে বিএনপি এখনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি, সেসব আসনেও মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নানাভাবে ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন। সবমিলিয়ে নির্বাচনি কর্মযজ্ঞ শুরু করেছেন বিএনপির মনোনয়নপ্রাপ্ত ও সম্ভাব্য প্রার্থীরা।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ইত্তেফাককে বলেন, এদেশের মানুষ বিগত তিনটি নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি। বিশেষ করে, একটি প্রজন্ম যারা নতুন ভোটার তারা ভোটই চোখে দেখেনি, তারা একটি নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছেন।
সারা দেশের মানুষ নির্বাচনের পক্ষে। কারণ দেশের জনগণ মনে করছে—একটি নির্বাচিত সরকার ছাড়া দেশে স্থিতিশীলতা আসবে না। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ সবকিছুই সচল হবে নির্বাচিত সরকার এলে। তিনি জানান, বিএনপির এখন পূর্ণ মনোনিবেশ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে। নির্বাচনে জনগণের রায় পেতে সব প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
বিএনপির মনোনয়নপ্রাপ্তরা ভোটের মাঠে নেমে পড়লেও দলটির মিত্র দল-জোটগুলোর নেতারা দিন গুনছেন আসন সমঝোতার অপেক্ষায়। তারা মনে করছেন, মিত্রদের আসনগুলোর বিষয়ে বিএনপি স্পষ্ট ঘোষণা দিলে দেশ জুড়ে পুরোদমে নির্বাচনি আবহ তৈরি হবে।
বিএনপির মিত্র জোট ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমরা মনে করি বিএনপির সঙ্গে অন্য যেসব দল বিগত ১৬-১৭ বছর আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে সক্রিয় ছিল, তাদের আসন ছাড়ের বিষয়টি দ্রুত ফয়সালা হওয়া জরুরি। এতে জোটের প্রার্থীরাও নিজেদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে দ্রুত নির্বাচনের মাঠে নামতে পারবেন।’
সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবি এখনো জারি রাখলেও জামায়াত ইতিমধ্যেই ২৯৯টি আসনে দলীয় প্রার্থী ঠিক করেছে। গত এক বছর ধরে বেশির ভাগ আসনে দলটি প্রার্থীর নাম সভা-সমাবেশে করে ঘোষণা দিয়েছে।
জামায়াতের প্রার্থীরা রাজধানীসহ সারা দেশেই ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীকে ভোট চেয়ে পোস্টার সাঁটিয়েছেন। দলটির নারী কর্মীরা দলের লিফলেট নিয়ে বাড়িতে-বাড়িতে যাচ্ছেন, উঠোন বৈঠক করছেন। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান ইতিমধ্যে জানিয়েছেন, চলতি মাসেই জামায়াত আনুষ্ঠানিক প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করবে।
জারিকৃত ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ’ নিয়ে নানা আপত্তি তুললেও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার নিজেই গতকাল শনিবার নিজ নির্বাচনি আসনে (খুলনা-৫, ডুমুরিয়া-ফুলতলা) নির্বাচনি শোভাযাত্রা ও পথসভা করেছেন।
খুলনার জিরো পয়েন্ট এলাকায় একপথসভায় তিনি প্রশাসনের প্রতি নিরপেক্ষ থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আপনারা আগামী নির্বাচন স্বচ্ছ করুন। প্রত্যেক প্রার্থী যেন সমান সুযোগ পেয়ে নির্বাচনি কাজ করতে পারেন।’
জামায়াতের অন্যতম নির্বাচনি মিত্র চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও প্রায় এক বছর ধরেই আসনে-আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করছে। দলটির প্রার্থীরা অনেক আগেই ‘হাতপাখা’ প্রতীকে ভোট চেয়ে এলাকায়-এলাকায় পোস্টার-ব্যানার লাগিয়েছেন। প্রার্থীরা প্রায় প্রতিদিনই নিজ এলাকায় পথসভা ও শোভাযাত্রা করছেন। চালাচ্ছেন প্রচারণা ও গণসংযোগ। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা রুটিন করে দলীয় প্রার্থীদের নির্বাচনি সভা-সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন।
ঢাকা-১২ (তেজগাঁও, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, হাতিরঝিল, শেরেবাংলা নগর) আসনে শুক্রবার নির্বাচনি শোডাউন করেছেন দলটির মনোনীত প্রার্থী তেজগাঁও রহিম মেটাল জামে মসজিদের খতিব মাওলানা মাহমুদুল হাসান মোমতাজী।
জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের আরেক জোটসঙ্গী বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশও ইতিমধ্যে বেশির ভাগ আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে। দলটির আমির মামুনুল হক বিভিন্ন সভা-সমাবেশে অংশ নিচ্ছেন। গতকালও একটি যোগদান অনুষ্ঠানে তিনি দলীয় প্রার্থীদের জন্য ‘রিকশা’ প্রতীকে ভোট চেয়েছেন।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনীতিতে আলোচিত এনসিপি ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি করছে। আগামী ২০ নভেম্বর এই ফরম বিক্রির কাজ শেষ হবে। এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতির পাশাপাশি দলটির নেতারা বিএনপি, জামায়াত ও সমমনা অন্য ৯টি দলের সঙ্গেও আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন জানিয়েছেন, এ মাসেই এনসিপি প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করবে। দলটির নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, আগামী নির্বাচনে ‘ধানের শীষ’-এর সঙ্গে লড়াই হবে ‘শাপলা কলি’র।
নুরুল হক নুরের গণ অধিকার পরিষদ, জোনায়েদ সাকির গণসংহতি আন্দোলন ও মজিবুর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিও ইতিমধ্যে দলীয় প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে। দলটির মনোনীত প্রার্থীরাও নিজ এলাকায় নির্বাচনি গণসংযোগ করছেন। গণ অধিকার পরিষদ ও গণসংহতি আন্দোলন আসন সমঝোতার বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। কর্নেল (অব.) অলি আহমদের এলডিপি, বিএনপি মিত্র জোট ‘১২ দলীয় জোট’ও প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে। ড. কামাল হোসেনের গণফোরামও গতকাল ১৩৩টি আসনে দলের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে। বিএনপির মিত্র এলডিপি, ১২ দলীয় জোট ও গণফোরামও আসন সমঝোতার অপেক্ষায়।
বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনহ উপরে উল্লেখিত দল-জোটসমূহ যখন পুরোপুরে নির্বাচনমুখী তখন বসে নেই বামপন্থি দলগুলোও। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তফ্রন্টের আদলে বামপন্থিদের নতুন একটি জোট হতে যাচ্ছে। দেশের প্রধান প্রধান বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক জোট ও দলের সমন্বয়ে ‘কনভেনশনে’র মাধ্যমে চলতি নভেম্বরেই এর আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটবে।
ছয়টি বাম দল নিয়ে গঠিত ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট এবং শরীফ নূরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাসদ বৃহত্তর এ জোট গঠনের মূল উদ্যোক্তা। বাম গণতান্ত্রিক জোটভুক্ত দলগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও বাসদ (মার্কসবাদী)। ধারাবাহিক যুগপত আন্দোলনে থাকা বামপন্থিদের আরেক জোট ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চার শরিক দলগুলোর সঙ্গেও বৃহত্তর জোট গঠনের আলোচনা হয়েছে।
এ জোটভুক্ত চারটি দল হচ্ছে- বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলন, বাসদ (মাহবুব), গণমুক্তি ইউনিয়ন। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, দলিত ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর একাধিক সংগঠন এবং গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ঐক্যসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক গণসংগঠন ও পেশাজীবী সংগঠনও নতুন জোটভুক্ত হওয়ার বিষয়ে সম্মতি দিয়েছে বলে জানা গেছে।